বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মানচিত্র
বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় দেশ, যেখানে প্রতিটি জেলা তার নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহন করে। দেশের ৬৪ জেলার মানচিত্র শুধু ভৌগোলিক চিত্র নয়, বরং একেকটি জেলার জীবনধারা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানুষের গল্পের প্রতিচ্ছবি। দেশের প্রতিটি অঞ্চলই একে অপরের থেকে আলাদা এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল
উত্তরাঞ্চল মূলত রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ নিয়ে গঠিত। এই অঞ্চল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, কৃষি উৎপাদন ও ঐতিহাসিক স্থাপনার জন্য বিখ্যাত। রংপুর, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী এবং পঞ্চগড় এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য জেলা।
এখানে শীতকালে আবহাওয়া ঠান্ডা থাকে এবং নদী ও বনাঞ্চল এই অঞ্চলের পরিবেশকে মনোরম করে তোলে। দিনাজপুরের শতবর্ষী কাঠামো, পঞ্চগড়ের চা বাগান এবং তিস্তা নদীর সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। কৃষিক্ষেত্রে ধান, ভুট্টা ও গম উৎপাদনে এই অঞ্চল দেশের শীর্ষে রয়েছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল
দক্ষিণাঞ্চল মূলত খুলনা ও বরিশাল বিভাগ নিয়ে গঠিত। এই অঞ্চল উপকূলীয় এলাকা, সুন্দরবন এবং সমুদ্রবন্দর নিয়ে বিখ্যাত। খুলনা, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরিশাল ও ভোলা এখানে উল্লেখযোগ্য জেলা।
সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। এই অঞ্চল চিংড়ি চাষ, মৎস্য আহরণ এবং লবণ উৎপাদনে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ও ভোলার দ্বীপাঞ্চল পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল
পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কয়েকটি জেলা অন্তর্ভুক্ত। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, সিলেট ও মৌলভীবাজার এই অঞ্চলের প্রধান জেলা।
এখানে রয়েছে পাহাড়, জলপ্রপাত, চা বাগান ও সমুদ্র সৈকতের সমাহার। কক্সবাজারের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, বান্দরবানের নীলগিরি ও নীলাচল, রাঙ্গামাটির কাপ্তাই লেক এবং সিলেটের সবুজ চা বাগান এই অঞ্চলের প্রধান আকর্ষণ। এই অঞ্চল দেশের পর্যটন শিল্পে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল
পশ্চিমাঞ্চলে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের কয়েকটি জেলা রয়েছে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ জেলা।
রাজশাহী আমের জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে। পদ্মা নদীর পাড়ের উর্বর মাটি এ অঞ্চলের কৃষিকে সমৃদ্ধ করেছে। কুষ্টিয়ার লালন শাহের স্মৃতিধাম এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ এখানে ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।
উত্তর সীমানা
বাংলাদেশের উত্তর সীমানা ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের সাথে যুক্ত। পাহাড়, নদী এবং চিরসবুজ বন এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। এখানে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি দেশের বৈচিত্র্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
পূর্ব সীমানা
পূর্ব সীমানা মিয়ানমার ও ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম এবং মেঘালয়ের সাথে যুক্ত। এখানে পাহাড়, জলপ্রপাত ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত রয়েছে। বান্দরবানের পাহাড়ি গ্রামগুলো দেশের পর্যটন মানচিত্রে বিশেষ স্থান দখল করেছে।
পশ্চিম সীমানা
পশ্চিম সীমানা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাথে সংযুক্ত। পদ্মা, মহানন্দা ও ভৈরব নদী এই অঞ্চলের জীবনধারায় বড় প্রভাব ফেলে। কৃষি ও সীমান্ত বাণিজ্য এ অঞ্চলের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি।
দক্ষিণ সীমানা
দক্ষিণ সীমানা বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত। উপকূলীয় এলাকা দেশের মৎস্য শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবনের বনাঞ্চল শুধু জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে না, বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলকে রক্ষা করে।
বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মানচিত্র

বাংলাদেশের ৬৪ জেলা আটটি বিভাগে বিভক্ত।
ঢাকা বিভাগ – ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, নরসিংদী।
চট্টগ্রাম বিভাগ – চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, কুমিল্লা।
রাজশাহী বিভাগ – রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুরহাট।
খুলনা বিভাগ – খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল।
বরিশাল বিভাগ – বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি।
সিলেট বিভাগ – সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ।
রংপুর বিভাগ – রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, পঞ্চগড়।
ময়মনসিংহ বিভাগ – ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোণা।
বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির দেশ, যেখানে প্রতিটি জেলা নিজস্ব পরিচয়, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। মোট ৬৪টি জেলা নিয়ে গঠিত এই দেশটি ভূগোল, প্রশাসন ও সংস্কৃতিতে অনন্য। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা শুধু প্রশাসনিক বিভাজন নয়, বরং দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশের ৬৪ জেলার তালিকা
বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে মোট ৮টি বিভাগ রয়েছে, এবং প্রতিটি বিভাগে একাধিক জেলা অন্তর্ভুক্ত। নিচে বিভাগের ভিত্তিতে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার নাম দেওয়া হলো:
ঢাকা বিভাগ: ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী।
চট্টগ্রাম বিভাগ: চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর।
বরিশাল বিভাগ: বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি।
খুলনা বিভাগ: খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, মাগুরা, নড়াইল, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা।
রাজশাহী বিভাগ: রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট।
সিলেট বিভাগ: সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ।
রংপুর বিভাগ: রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী।
ময়মনসিংহ বিভাগ: ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর।
প্রতিটি জেলার বিশেষত্ব
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার নিজস্ব ইতিহাস ও খ্যাতি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ,
- ঢাকা দেশের রাজধানী, যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল।
- চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী, সমুদ্রবন্দর ও পাহাড়-সমুদ্রের মেলবন্ধন।
- সিলেট চা-বাগান ও প্রবাসী অর্থনীতির জন্য বিখ্যাত।
- কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের জন্য পরিচিত।
- সুন্দরবন অবস্থিত খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায়, যা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল।
বাংলাদেশের মানচিত্রে ৬৪ জেলা
বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মানচিত্র শুধু একটি প্রশাসনিক নকশা নয়, বরং এটি দেশের ভৌগোলিক সৌন্দর্য, অর্থনীতি ও ঐতিহ্যের চিত্র তুলে ধরে। মানচিত্রে প্রতিটি জেলার সঠিক অবস্থান জানা ভ্রমণ, গবেষণা ও শিক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের জন্য এটি বাংলাদেশের ভূগোল শেখার একটি কার্যকর মাধ্যম।
ভ্রমণ ও গবেষণায় জেলার গুরুত্ব
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা পর্যটনের জন্য অনন্য। যেমন—
- বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি প্রাকৃতিক পাহাড়ি সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত।
- সুনামগঞ্জ হাওরের দেশ, বর্ষায় যা জলরাশির অপার সৌন্দর্য উপহার দেয়।
- পটুয়াখালী ও কুয়াকাটা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের একসাথে দেখা পাওয়ার জন্য জনপ্রিয়।
বাংলাদেশের ৬৪ জেলার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার ভাষা, পোশাক, খাবার ও উৎসব আলাদা। ময়মনসিংহের গীতি-কথা, চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, সিলেটের চা-শ্রমিকদের ঐতিহ্য—সবই বাংলাদেশের বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মানচিত্র ও নাম শুধু প্রশাসনিক তথ্য নয়, বরং দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভূগোলের এক অমূল্য দলিল। এই মানচিত্র আমাদের দেশের প্রতিটি কোণকে চেনাতে সাহায্য করে, আমাদের ঐতিহ্যের প্রতি গর্বিত করে এবং ভ্রমণ ও গবেষণায় সহায়তা করে। বাংলাদেশের এই বৈচিত্র্যই আমাদের শক্তি, যা আমাদের সংস্কৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মানচিত্র দেশের বৈচিত্র্য, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতিফলন। প্রতিটি জেলা তার নিজস্ব ইতিহাস, সম্পদ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম – প্রতিটি অঞ্চলের আলাদা রঙ, স্বাদ ও সৌন্দর্য রয়েছে, যা বাংলাদেশের পরিচয়কে অনন্য করে তুলেছে।










