ক্রোমোজোম কাকে বলে? এটি জীবদেহের কোষের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা জীবনের মূল রহস্য ধরে রাখে। জীববিজ্ঞানের এই বিষয়টি বোঝা আমাদের জন্য খুবই জরুরি, কারণ এটি জীবদেহের বংশগতি এবং বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে বড় ভূমিকা পালন করে।
ক্রোমোজোম কী?
জীবদেহের প্রতিটি কোষই একটি ছোট কারখানার মতো কাজ করে। কোষের ভেতরে থাকে নিউক্লিয়াস, যা কোষের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। এই নিউক্লিয়াসের ভেতর থাকে ক্রোমোজোম। ক্রোমোজোম হলো সুতার মতো গঠন, যা কোষ বিভাজনের সময় স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এটি মূলত ডিএনএ (DNA) এবং প্রোটিন দিয়ে তৈরি। ডিএনএ-তে থাকে জীবের বংশগত তথ্য, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়।
কোষের স্বাভাবিক অবস্থায় ক্রোমোজোমগুলো নিউক্লিয়াসের ভেতরে বিশৃঙ্খলভাবে থাকে। কিন্তু কোষ বিভাজনের সময়, বিশেষ করে প্রোফেজ এবং মেটাফেজ দশায়, এগুলো পানি বিয়োজনের মাধ্যমে সুতার মতো আকার নেয়। এই সময় ক্রোমোজোমগুলো স্পষ্টভাবে দেখা যায় এবং এরা জীবের বৈশিষ্ট্য বহন করে।
ক্রোমোজোমের সংখ্যা
প্রতিটি প্রজাতির কোষে ক্রোমোজোমের সংখ্যা নির্দিষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, মানুষের কোষে ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে, যেগুলো ২৩ জোড়ায় থাকে। একইভাবে, একটি প্রজাতির উদ্ভিদ বা প্রাণীর কোষে যদি ১২টি ক্রোমোজোম থাকে, তবে সেই প্রজাতির সব সদস্যের কোষে একই সংখ্যা থাকবে। এই নির্দিষ্ট সংখ্যা জীবের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে সাহায্য করে।
ক্রোমোজোম জীবের বংশগত তথ্য সংরক্ষণ করে। এটি জিনের মাধ্যমে আমাদের চোখের রঙ, উচ্চতা, এমনকি কিছু রোগের প্রবণতাও নির্ধারণ করে। কোষ বিভাজনের সময় ক্রোমোজোম নতুন কোষে সঠিকভাবে তথ্য স্থানান্তর করে, যাতে জীবের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ থাকে। এছাড়া, জীববিজ্ঞানের গবেষণায় ক্রোমোজোম অধ্যয়ন জেনেটিক রোগ বোঝা এবং চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ক্রোমোজোমের গঠন
ক্রোমোজোমের গঠন বোঝার জন্য আমাদের এর বিভিন্ন অংশ সম্পর্কে জানতে হবে। এটি সাধারণত লম্বা এবং সুতার মতো হয়, যা কোষ বিভাজনের সময় বিশেষ আকৃতি গ্রহণ করে। নিচে ক্রোমোজোমের প্রধান অংশগুলো বর্ণনা করা হলো:

ক্রোমোনেমা এবং ক্রোমাটিড
প্রতিটি ক্রোমোজোম দুটি সুতার মতো অংশ নিয়ে গঠিত, যাকে ক্রোমোনেমা বলা হয়। কোষ বিভাজনের সময়, প্রতিটি ক্রোমোজোম দুটি সমান অংশে বিভক্ত হয়, যাকে ক্রোমাটিড বলা হয়। প্রতিটি ক্রোমাটিড একটি ক্রোমোনেমা নিয়ে গঠিত। আধুনিক জীববিজ্ঞানে ক্রোমাটিড এবং ক্রোমোনেমাকে একই অংশের দুটি ভিন্ন নাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ক্রোমাটিডগুলো কোষ বিভাজনের সময় নতুন কোষে জিনগত তথ্য স্থানান্তর করে।
সেন্ট্রোমিয়ার
ক্রোমোজোমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সেন্ট্রোমিয়ার। মাইটোসিস কোষ বিভাজনের মেটাফেজ দশায়, ক্রোমোজোমে একটি গোলাকার এবং সংকুচিত অংশ দেখা যায়, যাকে সেন্ট্রোমিয়ার বলা হয়। কিছু ক্ষেত্রে এটিকে কাইনেটোকোরও বলা হয়। সেন্ট্রোমিয়ার ক্রোমোজোমের দুটি বাহুকে সংযুক্ত রাখে এবং কোষ বিভাজনের সময় স্পিন্ডল ফাইবারের সাথে যুক্ত হয়ে ক্রোমোজোমের নড়াচড়ায় সাহায্য করে।
বাহু
সেন্ট্রোমিয়ারের দুই পাশের অংশকে ক্রোমোজোমের বাহু বলা হয়। এই বাহুগুলোর দৈর্ঘ্য ক্রোমোজোমের ধরনের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। কিছু ক্রোমোজোমে দুটি বাহু সমান হয়, আবার কিছু ক্ষেত্রে একটি বাহু লম্বা এবং অন্যটি ছোট হয়।
ম্যাট্রিক্স এবং অন্যান্য উপাদান
পূর্বে ধারণা করা হতো যে ক্রোমোজোম একটি ম্যাট্রিক্স বা ধাত্র দ্বারা আবৃত থাকে। তবে আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, এটি আসলে প্রোটিন এবং অজৈব পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত। এই উপাদানগুলো সাধারণ মাইক্রোস্কোপে দেখা যায় না, তবে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে এদের গঠন পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।
ক্রোমোজোমের প্রকারভেদ
ক্রোমোজোমের প্রকারভেদ জীবের ধরন এবং কোষের কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে। উচ্চ শ্রেণির প্রাণী এবং উদ্ভিদের কোষে ক্রোমোজোম দুটি প্রধান ধরনে বিভক্ত: অটোজোম এবং সেক্স ক্রোমোজোম।
১. অটোজোম
অটোজোম হলো সেই ক্রোমোজোম, যা জীবের শারীরিক গঠন এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। এগুলো সাধারণত জোড়ায় থাকে এবং প্রতিটি জোড়ার দুটি ক্রোমোজোম একই ধরনের জিন বহন করে। মানুষের দেহকোষে মোট ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে, যার মধ্যে ২২ জোড়া অটোজোম। এই অটোজোমগুলো শরীরের গঠন, রং, উচ্চতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে।
২. সেক্স ক্রোমোজোম
সেক্স ক্রোমোজোম হলো সেই ক্রোমোজোম, যা জীবের লিঙ্গ নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। এগুলো সাধারণত X এবং Y নামে পরিচিত। মানুষের ক্ষেত্রে, পুরুষদের দেহকোষে একটি X এবং একটি Y ক্রোমোজোম থাকে (XY), আর নারীদের দেহকোষে দুটি X ক্রোমোজোম থাকে (XX)। মানুষের ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে এক জোড়া সেক্স ক্রোমোজোম হিসেবে কাজ করে।
ক্রোমোজোম জীবের জিনগত তথ্য সংরক্ষণ এবং স্থানান্তরের জন্য অপরিহার্য। এটি কোষ বিভাজনের মাধ্যমে নতুন কোষে জিনগত তথ্য সঠিকভাবে পৌঁছে দেয়। মাইটোসিস এবং মিয়োসিস প্রক্রিয়ায় ক্রোমোজোমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাইটোসিসে ক্রোমোজোম সমানভাবে দুটি কন্যা কোষে বিভক্ত হয়, আর মিয়োসিসে জনন কোষে জিনগত বৈচিত্র্য তৈরি করে।
ক্রোমোজোমের আকৃতি ও কার্যকারিতা
ক্রোমোজোমের আকৃতি কোষ বিভাজনের বিভিন্ন দশায় ভিন্ন হতে পারে। মেটাফেজ দশায় এটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়, যখন এটি X বা V আকৃতি ধারণ করে। সেন্ট্রোমিয়ারের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে ক্রোমোজোমকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যেমন:
- মেটাসেন্ট্রিক: সেন্ট্রোমিয়ার কেন্দ্রে থাকে, দুটি বাহু সমান।
- সাবমেটাসেন্ট্রিক: সেন্ট্রোমিয়ার কেন্দ্র থেকে সামান্য সরে থাকে, বাহুগুলো অসম।
- অ্যাক্রোসেন্ট্রিক: সেন্ট্রোমিয়ার এক প্রান্তে থাকে, একটি বাহু খুব ছোট।
- টেলোসেন্ট্রিক: সেন্ট্রোমিয়ার একেবারে প্রান্তে থাকে।
আরও পড়ুন- বায়োমেট্রিক কি?
শেষ কথা
ক্রোমোজোম জীববিজ্ঞানের একটি মৌলিক উপাদান, যা জীবের জিনগত তথ্য বহন এবং স্থানান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর গঠন, যেমন ক্রোমোনেমা, ক্রোমাটিড, সেন্ট্রোমিয়ার এবং বাহু, এবং প্রকারভেদ, যেমন অটোজোম এবং সেক্স ক্রোমোজোম, জীবের বৈচিত্র্য এবং বংশগতির জন্য অপরিহার্য।
ক্রোমোজোম জীবদেহের একটি অপরিহার্য অংশ, যা জীবনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে। এটি কেবল জীবের বৈশিষ্ট্যই নির্ধারণ করে না, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তথ্য স্থানান্তর করে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ক্রোমোজোম হলো জীবনের নীলনকশা।










