শিশুশ্রম রচনা ২০ পয়েন্ট একটি গুরুতর সমস্যা

Written by Jarif Al Hadee

Published on:

বাংলাদেশে শিশুশ্রমের সমস্যা দিন দিন বাড়ছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিপন্ন করছে। এই লেখায় শিশুশ্রমের কারণ, প্রভাব এবং প্রতিরোধের বাস্তবসম্মত উপায় নিয়ে বিস্তারিত জানুন, যাতে আমরা সকলে মিলে এই অন্ধকার অধ্যায় থেকে বেরিয়ে আসতে পারি।

WhatsApp Group Join Now

ভূমিকা

শিশুরা যেন দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। তারাই তো একদিন বড় হয়ে সমাজ চালাবে, দেশ গড়বে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের বাংলাদেশে অনেক শিশু ছোটবেলা থেকেই জীবনের কঠিন লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। দারিদ্র্যের চাপে, অশিক্ষার অন্ধকারে তারা খেলাধুলা, পড়াশোনার স্বপ্ন ভুলে যায় এবং কাজের ময়দানে নেমে আসে। শিশুশ্রম বলতে আমরা বুঝি, ১৮ বছরের নিচের বয়সী ছেলেমেয়েদের এমন কাজে ব্যবহার করা, যা তাদের শারীরিক, মানসিক বা শিক্ষাগত বিকাশের পথে বাধা দেয়। এটি শুধু একটা সমস্যা নয়, বরং একটা জাতীয় বিপর্যয়। আজকের এই লেখায় আমরা শিশুশ্রমের গভীরতা খুঁজে দেখব, তার কারণগুলো বুঝব এবং সমাধানের উপায় খুঁজব। কারণ, শিশুদের হাসি-খুশি জীবন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই সমস্যা নিয়ে সচেতন হয়ে উঠতে হবে সকলকে—সরকার, সমাজ এবং আমরা সাধারণ মানুষ।

শিশুশ্রম কী

শিশুশ্রম বলতে কী বোঝায়? সহজ কথায়, এটি হলো এমন কোনো কাজ যা শিশুদের শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে দেয় বা তাদের স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো জীবনযাপনের সুযোগ কেড়ে নেয়। বাংলাদেশে এই সমস্যা খুবই ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামের ধানখেত থেকে শুরু করে শহরের ট্রাফিক জ্যামের মাঝে, ছেলেমেয়েরা সব জায়গায় কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার রাস্তায় রিকশা ঠেলা, চায়ের দোকানে কাপ ধোয়া বা কারখানায় সেলাই মেশিন চালানো—এসব কাজ শিশুদের হাতে দেখা যায়।

এই শিশুশ্রমের প্রকৃতি বেশ বিভিন্ন। কিছু কাজ হালকা মনে হলেও, সেগুলো শিশুদের স্বপ্নগুলোকে চুরি করে নেয়। যেমন, বাসায় রান্না-বান্না সাহায্য করা বা দোকানে ছোটখাটো কাজ। কিন্তু আরও ভয়াবহ হলো ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো। ইটভাটায় ইট বহন করা, পাহাড় কাটা বা গ্যারেজে গাড়ির নিচে শুয়ে মেরামত করা এসব কাজে শিশুরা প্রতিদিন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে হাজার হাজার শিশু কাজ করে, যেখানে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয় এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। আরও দুঃখের কথা, কিছু অসৎ লোক শিশুদের অপহরণ করে বিদেশে পাচার করে, যেখানে তারা উটের জোকি বা অন্যান্য বিপজ্জনক কাজে ব্যবহৃত হয়। এই সব কাজের পিছনে লুকিয়ে আছে দারিদ্র্যের ছায়া। পরিবারের আর্থিক চাপে শিশুরা ছোট থেকেই উপার্জনের বোঝা নেয়। কিন্তু এতে তাদের শরীর দুর্বল হয়, মন ভেঙে যায় এবং ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে ওঠে। শিশুশ্রমের এই প্রকৃতি বোঝা গেলে তবেই আমরা এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারব।

শিশুশ্রমের কারণসমূহ

শিশুশ্রমের পিছনে অনেক কারণ লুকিয়ে আছে, যা একে অপরের সাথে জড়িত। প্রথম এবং সবচেয়ে বড় কারণ হলো দারিদ্র্য। বাংলাদেশে অনেক পরিবারের আয় এত কম যে, একজন উপার্জনকারীর আয়ে সবাই চলে না। ফলে শিশুরা কাজে বেরিয়ে পড়ে, যাতে পরিবারের পেট ভরে। উদাহরণ দিই, একটা গ্রামের পরিবারে যদি পাঁচ-ছয় ছেলেমেয়ে থাকে এবং বাবা কৃষিকাজ করে, তাহলে শিশুরা খেতে সাহায্য করে বা শহরে গিয়ে চা-দোকানে কাজ করে।

দ্বিতীয় কারণ অশিক্ষা। অনেক অভিভাবক নিজেরা পড়াশোনা করেনি, তাই তারা বোঝে না যে শিক্ষা শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ে। তারা মনে করে, কাজ করলে শিশু দ্রুত স্বাবলম্বী হবে। কিন্তু এতে শিশুরা স্কুল ছেড়ে দেয় এবং চিরকালের জন্য অশিক্ষিত থেকে যায়। তৃতীয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি। বড় পরিবারে সবাইকে খাওয়ানো-পরানো কঠিন, তাই শিশুদের উপার্জনের উপর চাপ পড়ে। চতুর্থ, সামাজিক সচেতনতার অভাব। সমাজের অনেকে শিশু শ্রমকে স্বাভাবিক মনে করে, বলে “এ তো আমাদের সময়েও হয়েছে”। কিন্তু এখন সময় বদলে গেছে। পঞ্চম, বাজারের চাহিদা। অনেক কারখানা মালিক সস্তা শ্রমিক চায়, শিশুরা সস্তায় পাওয়া যায় বলে তারা নিয়োগ করে। এছাড়া, যুদ্ধ-বিপর্যয় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগও শিশুশ্রম বাড়ায়। বাংলাদেশে বন্যা-আউশে অনেক পরিবার বাস্তুহারা হয়, তাদের শিশুরা রাস্তায় নামে। এই কারণগুলো চেনা গেলে তবেই সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে।

শিশুশ্রমের প্রভাব

শিশুশ্রমের প্রভাব শুধু শিশুর উপর নয়, সমগ্র সমাজের উপর। প্রথমত, শারীরিক ক্ষতি। ছোট শরীরে ভারী কাজ করলে হাড় ভাঙে, শ্বাসকষ্ট হয়, দুর্ঘটনায় প্রাণ যায়। উদাহরণস্বরূপ, ইটভাটায় কাজ করা শিশুরা ফুসফুসের রোগে ভুগে। দ্বিতীয়, মানসিক আঘাত। তারা খেলতে পারে না, বন্ধুবান্ধবের সাথে মিশতে পারে না, ফলে বিষণ্ণতা, ভয় এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়। তৃতীয়, শিক্ষার ক্ষতি। স্কুল ছেড়ে দেওয়ায় তারা অশিক্ষিত থেকে যায়, যা চিরকালের জন্য তাদের জীবনকে সীমিত করে।

সমাজের উপর প্রভাব আরও গভীর। শিশুশ্রম বাড়লে অশিক্ষা বাড়ে, অপরাধ বাড়ে, এবং দেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়। একটা শিশু যদি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে উঠতে পারে, তাহলে দেশ উন্নত হয়। কিন্তু শ্রমিক হয়ে থাকলে সেই সম্ভাবনা চলে যায়। পরিবেশের উপরও প্রভাব পড়ে—শিশুরা নিরাপত্তাহীনভাবে কাজ করলে দুর্ঘটনা বাড়ে, যা সমাজের বোঝা। মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রে এটি আরও ভয়াবহ, কারণ তারা শোষণের শিকার হয়। সামগ্রিকভাবে, শিশুশ্রম দেশের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে তোলে। আমাদের এখনই সচেতন হয়ে উঠতে হবে এই প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য।

আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইন

শিশু অধিকার বিশ্বব্যাপী একটা মৌলিক বিষয়। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে, প্রত্যেক শিশুর শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার অধিকার আছে। বাংলাদেশ এই সনদে স্বাক্ষর করেছে, তাই আমাদের দেশে শিশু অধিকার আইন রয়েছে। এই আইনে ১৮ বছরের নিচের সকলকে শিশু বলে গণ্য করা হয়েছে। ধারা ৩২-এ বলা আছে, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে রক্ষা করতে হবে, যাতে তাদের উন্নয়ন না বাধাগ্রস্ত হয়। ধারা ৩৪-এ নির্যাতন থেকে সুরক্ষা এবং ধারা ২৮-এ শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

জাতীয়ভাবে, শ্রম আইনে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। সরকার শিশু শ্রম নির্মূলের জন্য নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু বাস্তবে এই আইনগুলো পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না, কারণ সচেতনতার অভাব এবং প্রয়োগের দুর্বলতা। বিশ্বের অন্যান্য দেশে, যেমন ইউরোপে, কঠোর আইন এবং শিক্ষা কর্মসূচির কারণে শিশুশ্রম অনেক কম। আমাদেরও এই পথ অনুসরণ করতে হবে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা মনে পড়ে: “এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান”। এই কথা বাস্তবে রূপ দেওয়া দরকার, যাতে শিশুরা অন্ধকার থেকে আলোয় উঠে আসে।

শিশুশ্রম নিরসনের পদক্ষেপ

শিশুশ্রম বন্ধ করা সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়। সরকার ইতিমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, স্কুলে বিনামূল্যে বই-খাতা দেওয়া এবং খাদ্য সাহায্য কর্মসূচি চালু করা। মেয়েদের জন্য এসএসসি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা এবং উপবৃত্তি প্রদানও চলছে। পোশাক শিল্পে শিশু শ্রমিকদের শিক্ষায় ফিরিয়ে আনার প্রকল্প আছে।

কিন্তু আরও অনেক কিছু করতে হবে। প্রথম, এনজিও এবং সরকার মিলে পথশিশু এবং অবহেলিত শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র খোলা। কারিগরি শিক্ষাকে প্রসারিত করা, যাতে শিশুরা দক্ষতা শিখে ভালো চাকরি পায়। দ্বিতীয়, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মনিটরিং বাড়ানো—পুলিশ এবং শ্রম অফিসের নিয়মিত চেক। তৃতীয়, গণসচেতনতা বাড়ানোর জন্য টিভি, রেডিও এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার। চতুর্থ, শিশু পাচার রোধে সীমান্তে কঠোর নজরদারি এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তি। পঞ্চম, দারিদ্র্য হ্রাসের কর্মসূচিতে শিশুদের অন্তর্ভুক্তি—যেমন, পরিবারকে সাহায্য করে শিশুদের কাজ থেকে মুক্ত করা। ষষ্ঠ, মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা: খাবার, পোশাক, চিকিত্সা এবং আশ্রয়। সপ্তম, সমাজের সকল স্তরে শিশু নির্যাতন বিরুদ্ধে সচেতনতা চালানো। এই পদক্ষেপগুলো যদি একসাথে নেওয়া হয়, তাহলে শিশুশ্রম অনেকটা কমবে।

উপসংহার

শিশুশ্রম বাংলাদেশের একটা বড় সমস্যা, যা আমাদের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এটি হঠাৎ বন্ধ করা যাবে না, কিন্তু ধাপে ধাপে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কারণগুলো চিহ্নিত করে, আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করে এবং সকলে মিলে সচেতন হয়ে আমরা এই অন্ধকার দূর করতে পারি। সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও দায়িত্ব আছে—শিশুদের হাতে বই দিন, না কাজের যন্ত্র। তবেই বাংলাদেশ একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দেশ হবে, যেখানে প্রত্যেক শিশুর স্বপ্ন পূরণ হবে। আসুন, আজ থেকেই শুরু করি এই যাত্রা।

প্রশ্নোত্তর

শিশুশ্রম কীভাবে শনাক্ত করা যায়?

শিশুশ্রম হলো ১৮ বছরের নিচের শিশুদের এমন কাজ যা তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা বিকাশের ক্ষতি করে। যেমন, কারখানায় দীর্ঘক্ষণ কাজ বা বিপজ্জনক মাইনিং।

বাংলাদেশে শিশুশ্রমের হার কত?

সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, লক্ষাধিক শিশু বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। এটি দিন দিন বাড়ছে দারিদ্র্যের কারণে।

শিশুশ্রম বন্ধ করতে আমরা কী করতে পারি?

সচেতনতা ছড়ান, শিশু শ্রমিক দেখলে রিপোর্ট করুন, শিক্ষা প্রচার করুন এবং সরকারি কর্মসূচিতে অংশ নিন। ছোট ছোট পদক্ষেপ বড় পরিবর্তন আনে।

শিশু অধিকার আইন কী বলে?

এটি শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ নিষিদ্ধ এবং নির্যাতনের শাস্তি আছে।

শিশুশ্রমের সবচেয়ে বড় কারণ কী?

দারিদ্র্য এবং অশিক্ষা। পরিবারের আর্থিক চাপে শিশুরা কাজ করে, কিন্তু শিক্ষা না পেলে চক্রটি চলতে থাকে।

DMCA.com Protection Status
Jarif Al Hadee

হ্যালো, আমি জারীফ আল হাদী- Jarif Al Hadee। আমি এই ওয়েবসাইটের এডমিন এবং একজন লেখক। আমি দীর্ঘ ৪ বছর ধরে শিক্ষা সম্পর্কিত লেখালেখির সাথে জড়িত। আমি পাঠকদের মানসম্মত ও আপডেটেড তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করি আমার লেখাগুলোতে। যোগাযোগ- admissiongodesk@gmail.com।