ভূমিকা
খাদ্য ভেজাল বলতে বোঝায় যখন কোনো খাবারে তার আসল উপাদানের পরিবর্তে সস্তা বা ক্ষতিকর জিনিস মিশিয়ে দেওয়া হয়, যাতে বিক্রেতা বেশি লাভ করে। উদাহরণস্বরূপ, দুধে পানি মিশানো বা চালে পাথরের টুকরো যোগ করা। বাংলাদেশে এই সমস্যা অনেক দিনের, কিন্তু আজকাল যন্ত্রপাতির সাহায্যে এতটা চালাকিপূর্ণভাবে করা হয় যে সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না।
আমাদের দেশে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ এমন খাবার খায় যাতে বিষাক্ত রং, কেমিক্যাল বা অখাদ্য জিনিস মিশে থাকে। এতে শুধু পকেটের ক্ষতি নয়, স্বাস্থ্যেরও বিপদ বাড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, খাদ্য ভেজালের ফলে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন রোগে পড়ে। এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব কেন এমন হয়, কোথায় হয় এবং কী করা যায়। যদি আপনি সচেতন ভোক্তা হতে চান, তাহলে এটি পড়ে শেষ করুন।
খাদ্য ভেজালের মূল কারণ কী কী
খাদ্য ভেজালের পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো লোভ। ব্যবসায়ীরা সামান্য বেশি টাকা রোজগারের জন্য মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে খেলেন। তারা জানেন যে বাজারে চাহিদা অনেক, আর সরকারের তদারকি কম। ফলে, অনেক কারখানা বা দোকানে ছাড়পত্র ছাড়াই উৎপাদন চলে।
বাংলাদেশে এখনও পুরনো আইন চালু আছে, যা ভেজাল রোধ করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, বিএসটিআই-এর মতো সংস্থা সক্রিয় না থাকায় ভুয়া লেবেল লাগিয়ে জিনিস বিক্রি হয়। এছাড়া, ভোক্তাদের অজ্ঞতাও একটা কারণ। অনেকে সস্তা দাম দেখে কিনে ফেলেন, জেনেশুনেও। আমাদের সমাজে সততার অভাব এবং দুর্নীতি এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। যদি সবাই সচেতন হয়, তাহলে এটা কমানো যায়।
বাংলাদেশের বাজারে খাদ্য ভেজালের নানা রূপ
বাংলাদেশের বাজারে কোনো খাবারই ভেজালমুক্ত নয়। চলুন, কয়েকটা উদাহরণ দেখি।
প্রতিদিনের খাবার শাকসবজি আর ফলমূলে ক্যালসিয়াম কার্বাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করে পাকানো হয়। এতে ফল সতেজ দেখায়, কিন্তু খেলে পেট খারাপ, কিডনি সমস্যা বা এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। ঢাকার বাজারে এমন ফলের পরিমাণ অনেক।
বাজারের ঘি আর তেলে পশুর চর্বি বা ক্ষতিকর রং মেশানো হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশের বেশি ঘি ভেজাল। এগুলো খেলে হার্টের সমস্যা বা লিভারের ক্ষতি হয়। সয়াবিন তেলে ডালডা মিশিয়ে বিক্রি হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক।
মাছে ফরমালিন ঢেলে সতেজ রাখা হয়, যা ক্যান্সার সৃষ্টি করে। আমদানি মাছে এটা বেশি। মাংসে গরুর পরিবর্তে মহিষের মাংস বিক্রি হয়। শুঁটকিতে কীটনাশক মিশে থাকে, যা শ্বাসকষ্টের কারণ।
চালে বালি মেশানো সাধারণ, ডালে কৃত্রিম রং। আটায় মাইকোটক্সিনের মতো বিষ থাকে। মুড়িতে ইউরিয়া ব্যবহার হয়, যা ডায়াবেটিস বাড়ায়।
মিনারেল ওয়াটারে ৯৫ শতাংশ পানি অযোগ্য। জুসে ফলের রস নেই, শুধু কৃত্রিম স্বাদ। জ্যামে বিষাক্ত রং মেশানো হয়। আইসক্রিমও একই রকম।
শিশুদুধে পানি মিশানো হয়, লেবেলে লেখা উপাদান পাওয়া যায় না। চকোলেটে ক্ষতিকর গন্ধ যোগ করা হয়।
হোটেলে পুরনো তেলে ভাজা খাবার, মিষ্টিতে মেয়াদোত্তীর্ণ দুধ। চানাচুরে মবিল তেল ব্যবহার হয়। ৯০ শতাংশ রেস্তোরাঁর খাবারের মান খারাপ। এসব উদাহরণ দেখায় যে খাদ্য ভেজাল সর্বত্র।
খাদ্য ভেজালের স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক প্রভাব
খাদ্য ভেজাল খেলে ক্যান্সার, কিডনি ফেলিয়র, হার্ট অ্যাটাকের মতো রোগ হয়। শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। দেশের অর্থনীতিতে ক্ষতি হয়, কারণ চিকিত্সায় লক্ষাধিক টাকা খরচ। জনস্বাস্থ্য খারাপ হলে উৎপাদনশীলতা কমে।
খাদ্য ভেজাল প্রতিরোধের সহজ উপায়সমূহ
প্রতিরোধের জন্য প্রথমে সচেতন হোন। লেবেল চেক করুন, বিশ্বাসযোগ্য দোকান থেকে কিনুন। বাড়িতে সাধারণ পরীক্ষা করুন, যেমন ডালে রং ধোয়া যায় কি না। সরকারকে চাপ দিন আইন কঠোর করার জন্য। বিএসটিআই-কে সক্রিয় করুন। সামাজিক আন্দোলন গড়ুন। ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ দিন। এভাবে আমরা ভেজালমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারি।
উপসংহার
খাদ্য ভেজাল আমাদের দেশের একটা বড় সমস্যা, যা স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এটি আমাদের নৈতিকতার দুর্বলতা দেখায়। কিন্তু সচেতনতা এবং যৌথ প্রচেষ্টায় আমরা এর থেকে মুক্তি পেতে পারি। সরকার, ব্যবসায়ী এবং ভোক্তা সবাই মিলে কাজ করলে একটা সুস্থ বাংলাদেশ সম্ভব। আজ থেকেই শুরু করুন, আপনার পরিবারকে রক্ষা করুন।
প্রশ্ন-উত্তর
লেবেল দেখুন, দাম অস্বাভাবিক কম হলে সন্দেহ করুন। বাড়িতে সরল পরীক্ষা করুন, যেমন ফলে গ্যাসের গন্ধ থাকলে বিপদ।
খুব বেশি, কারণ তাদের শরীর দুর্বল। বিষাক্ত খাবার খেলে বৃদ্ধি বন্ধ হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগ হয়।
ভেজাল দম্ন আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ দুর্বল। কঠোর শাস্তি দরকার।
তেল, ঘি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারে সবচেয়ে বেশি।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানান এবং সচেতনতা ছড়ান।










