১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কীভাবে স্বাধীনতার আহ্বান ছড়িয়ে দিয়েছিল? এই লেখায় জানুন রেডিওর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা এবং বিশ্ব জনমত গঠনের গল্প। বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমর অধ্যায়।
ভূমিকা
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অমর অধ্যায়। এই যুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে বলেন, গণমাধ্যম ছিল যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি যখন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নির্মম আক্রমণে বিহ্বল, শোকাহত এবং কামানের গোলায় পুলিশ স্টেশনগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল, তখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর-এর কিছু সাহসী সদস্যরা প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ঠিক এই সময় জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রচারের এক শক্তিশালী অস্ত্র। অন্যান্য গণমাধ্যমও যুদ্ধের খবর ছড়িয়ে দিয়ে জনগণকে একত্রিত করেছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে শুধু স্থানীয় খবরই ছড়ানো হয়নি, বরং বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সংগ্রামের কথা পৌঁছে দিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন আকর্ষণ করা হয়েছিল। এই কেন্দ্রটি ছিল যেন একটা অদৃশ্য সেনাবাহিনী, যা কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে যোদ্ধাদের হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়েছে। আজও এর অবদান মনে করলে বুক গর্বে ভরে ওঠে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উত্থান
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই ভয়াবহ রাতে, যখন পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে, তখন চট্টগ্রাম বেতারের দশজন সাহসী কর্মকর্তা কাজ শুরু করেন। তারা কালুরঘাটের ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করেন। পরের দিন, ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে আবুল কাশেম সন্দ্বীপের কণ্ঠে প্রথম সম্প্রচার হয়: “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।” এই কথাগুলো শুনে জনগণের মনে নতুন আশার আলো জ্বলে ওঠে। এরপর থেকে এই কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের প্রচারে সক্রিয় হয়ে ওঠে। প্রতিদিন সকাল নয়টা, দুপুর একটা এবং সন্ধ্যা সাতটায় তিনটি অধিবেশন চলে। এই সম্প্রচারগুলো শুধু খবরই নয়, বরং জনগণকে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আহ্বানও বহন করত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গী, যা তাদেরকে একা অনুভব করতে দেয়নি।
স্বাধীনতার ঘোষণা
২৭ মার্চ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এই ঘোষণা ছিল যুদ্ধের সূচনা। “আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করব,” এই কথা শুনে সারা দেশে একটা ঢেউ উঠে যায়। এই ঘোষণা শুধু স্থানীয় জনগণকেই উত্তেজিত করে না, বরং বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রতিদিনের অধিবেশনে এই ঘোষণার প্রভাব নিয়ে আলোচনা হতো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই ভূমিকা ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের ভিত্তি স্থাপনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি ছাড়া যুদ্ধের এতটা ছড়িয়ে পড়া সম্ভব হতো না।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠান
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান সম্প্রচার হতো, যা মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের আহ্বান, মুক্তিবাহিনীর সাম্প্রতিক অগ্রগতির খবর, দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য, কথোপকথন এবং চরমপত্র—এসব ছিল জনপ্রিয়। এই অনুষ্ঠানগুলো জনগণকে শক্তি দিত। উদাহরণস্বরূপ, মুক্তিবাহিনীর একটা সফল হামলার খবর শুনে যোদ্ধারা নতুন করে লড়াইয়ে উদ্যত হতেন। এছাড়া, দৈনন্দিন জীবনে যুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলায় পরামর্শও দেওয়া হতো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই অনুষ্ঠানগুলো ছিল যেন একটা মানসিক অস্ত্র, যা শত্রুকে ভয় দেখাতো।
সীমান্তবর্তী এলাকায় নতুন শুরু
৩০ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বোমা হামলায় কালুরঘাটের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সাহসী কর্মীরা হার মানেননি। ৩ এপ্রিল থেকে রামগড়ের সীমান্ত এলাকা থেকে দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। এখানে প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে সাড়ে নয়টা এবং সন্ধ্যা সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত দুটি অধিবেশন চলে। যুদ্ধের খবর, পুরনো গ্রামোফোন রেকর্ডের গান, বিমান হামলার সময় কী করতে হবে সে সম্পর্কে সতর্কতা—এসব সম্প্রচার হতো। এছাড়া, তাৎক্ষণিক কথোপকথন এবং কবিতা জনগণের মনে উদ্দীপনা জাগাতো। এই সীমান্তবর্তী কেন্দ্রটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের একটা নিরাপদ আশ্রয়, যা থেকে সংবাদের প্রবাহ অবিরত চলত।
মুজিবনগরের বেতার কেন্দ্র
১০ এপ্রিল মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠিত হলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নতুন করে গড়ে ওঠে। রাজশাহী বেতারের শামসুল হুদা চৌধুরী, ঢাকা বেতারের আশফাকুর রহমান, এম আর আখতার মুকুল, পটুয়া কামরুল হাসান, তাহের সুলতানসহ অনেকে ৫০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার চালু করার জন্য কাজ করেন। এই কেন্দ্রটি ছিল সংগঠিত প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু। এখান থেকে যুদ্ধের খবর, সরকারের নির্দেশনা এবং জনগণের করণীয় সম্পর্কে তথ্য সম্প্রচার হতো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই পর্যায়ে প্রচার আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যা মুক্তিযুদ্ধকে নতুন গতি দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের গান ও কবিতা
মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বেতারকর্মী, কথক এবং শিল্পীরা জড়ো হয়েছিলেন। সীমান্ত পেরিয়ে খ্যাতনামা ব্যক্তিরা এসে অংশ নেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের “শোনো একটা মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের” গান অংশুমান রায়ের কণ্ঠে সম্প্রচার হতো। গোবিন্দ হালদারের “মোরা একটা ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি” কবিতাও জনপ্রিয় ছিল। এই গান-কবিতাগুলো যোদ্ধাদের মনে সাহস ভরে দিত। সীমিত সরঞ্জাম সত্ত্বেও এগুলো মুক্তিযুদ্ধের আত্মা জাগিয়ে তুলত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই অংশ ছিল সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রতীক।
জনগণকে সচেতন করা
যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের মানুষকে তাদের করণীয় সম্পর্কে জানানো হতো। শোক-বেদনা ভুলে শত্রুকে দমন করার আহ্বান করা হতো। এই অনুষ্ঠানগুলো জনগণকে স্বাধীনতার পথে দীক্ষিত করত। উদাহরণস্বরূপ, গেরিলা যুদ্ধের কৌশল বা শরণার্থীদের সাহায্যের উপায় নিয়ে আলোচনা হতো। এতে জনগণ যুদ্ধের অংশীদার হয়ে উঠত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই ভূমিকা ছিল জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলায় অপরিহার্য।
চরমপত্র
এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হতো। “ঢাকায় মেজিক কারবার চলছে, চা-রোমড়ার থেকে গাবুর বাড়িতে কেচকা মাইর খেয়ে ভোমা সোলজাররা তেজগাঁওয়ে দম ফেলছে”—এমন রসাত্মক বাক্য মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণকে হাসিয়ে অনুপ্রাণিত করত। এছাড়া, “জল্লাদের দরবার”, “পিন্ডির প্রলাপ”, “প্রতিনিধির কণ্ঠ” এবং সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে অনুষ্ঠানও সম্প্রচার হতো। বিশ্ব জনমত গঠনে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই অনুষ্ঠানগুলো শত্রুকে মানসিকভাবে পরাজিত করত।
সংবাদপত্রের অবদান
২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি বাহিনী সব পত্রিকা নিষিদ্ধ করে দিলেও অঞ্চলভিত্তিক কাগজপত্র বের হয়। ১৭ এপ্রিল বরিশাল থেকে “বাংলাদেশ” নামে একটা অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর প্রথম সম্পাদকীয়ে বিশ্বের মানবতাবাদীদের কাছে অত্যাচারের বিরুদ্ধে আবেদন করা হয়। এই পত্রিকাগুলো গোপনে ছাপা হয়ে যোদ্ধাদের হাতে পৌঁছে যেত। সংবাদপত্রের এই ভূমিকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের লিখিত অস্ত্র।
বিদেশী গণমাধ্যম
বিদেশী গণমাধ্যমও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিল। মিশরের কায়রোর আল-আহরাম পত্রিকার সম্পাদক ড. মাকসুদ বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মমতায় বিশ্ব অবাক। এই পত্রিকা স্বাধীনতার পক্ষে দাবি তুলে। যুগান্তর, হিন্দুস্তান টাইমস, কালান্তর, কম্পাস, নিউ এজ—এসব কাগজ শরণার্থী এবং যুদ্ধের প্রতিবেদন ছাপে। এতে বিশ্ব জনমত গঠিত হয় এবং অনেক দেশ সাহায্য পাঠায়।
বিবিসির স্মরণীয় অবদান
বিবিসির ভূমিকা ছিল অসাধারণ। সাপ্তাহিক সংবাদ পরিক্রমায় যুক্তরাজ্যের পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করা হতো। ২৫ মার্চের গণহত্যা এবং ২৬ মার্চের ঘোষণার খবরও সম্প্রচার হয়। ডেইলি টেলিগ্রাফ, গার্ডিয়ান, নিউ স্টেটম্যান, টাইমস, ইকোনমিস্ট, সানডে টেলিগ্রাফ, অবজারভার, ফাইনান্সিয়াল টাইমস, ডেইলি মিরর এবং ভারতের অমৃত বাজার পত্রিকা, আনন্দবাজার, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস—এসব মিলে বিশ্বকে জাগিয়ে তোলে। বিবিসির এই কাজ মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে আসে।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশি এবং বিদেশী গণমাধ্যমের অবদানের পরিমাপ করা কঠিন। তাদের সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান, খবর এবং প্রতিবেদন একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে, অন্যদিকে বিশ্ব জনমত গঠনে সাহায্য করেছে। এতে পাকিস্তানি বাহিনী মানসিকভাবে পরাজিত হয় এবং বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নামে এক সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠস্বর আজও আমাদের স্মৃতিতে বেঁচে আছে, যা স্বাধীনতার মূল্য স্মরণ করিয়ে দেয়। এই ঐতিহাসিক অধ্যায় থেকে আমরা শিখি, সত্যের কণ্ঠ কখনো নীরব হয় না।

 
			
 
    







