আমি এই লেখায় রচনা আমার প্রিয় কবি সম্পর্কে একটি রচনা লিখেছি সহজ ভাষায়। কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী, তাঁর বিখ্যাত কবিতা এবং কেন তিনি আমার প্রিয় কবি সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। বিদ্রোহী কবির সংগ্রামী চেতনা, প্রেমের গান এবং বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রভাব জানুন। এই লেখা আপনাকে নজরুলের অমর সৃষ্টির সাথে পরিচয় করাবে।
ভূমিকা
বাংলা সাহিত্যের আকাশে অনেক কবি এসেছেন যারা তাঁদের কবিতা দিয়ে মানুষের মন জয় করেছেন। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় যিনি, তিনি হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কবিতা পড়লে মনে হয় যেন একটা আগুনের ঝলকানি, যা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি শুধু কবিতা লিখেছেন না, তাঁর লেখায় রয়েছে বিপ্লবের আহ্বান, প্রেমের মাধুর্য এবং মানবতার বার্তা। বাংলা সাহিত্যে তাঁকে বলা হয় বিদ্রোহী কবি। আমার প্রিয় কবি হিসেবে নজরুলের সাথে আমার পরিচয় শুরু হয়েছে কৈশোরে, যখন আমি প্রথম পড়ি তাঁর কবিতা “আমি হব সকাল বেলার পাখি, সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি“। এই লাইনগুলো আমাকে এমনভাবে ছুঁয়েছে যে, আমি তাঁর কবিতার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। আজ এই লেখায় আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করব কেন নজরুল আমার প্রিয় কবি, তাঁর জীবনকাহিনি এবং তাঁর কবিতার কিছু অংশ। আশা করি, এই লেখা পড়ে আপনারাও নজরুলের প্রতি আকৃষ্ট হবেন।
নজরুলের কবিতায় রয়েছে একটা অনন্য মিশ্রণ – একদিকে বিদ্রোহের আগুন, অন্যদিকে প্রেমের মধুর সুর। তিনি লিখেছেন অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প এবং নাটক। তাঁর কাজগুলো বাংলা সাহিত্যকে নতুন দিক দেখিয়েছে। যেমন, তাঁর “বিদ্রোহী” কবিতা পড়লে মনে হয় যেন একটা ঝড় উঠেছে, যা সব অন্যায়কে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। এই কবিতায় তিনি বলেছেন, “বল বীর বল উন্নত মম শির শির, শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর”। এই লাইনগুলো আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করে। নজরুলের কবিতা শুধু বিনোদনের জন্য নয়, এতে রয়েছে সমাজের সমস্যা নিয়ে চিন্তা। তিনি অন্যায়, শোষণ এবং জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা বলেছেন। এজন্যই তিনি আমার প্রিয় কবি। এখন চলুন বিস্তারিত জেনে নিই তাঁর কবিতা এবং জীবন সম্পর্কে।
বাংলা কাব্যে নজরুলের অবদান
বাংলা কাব্যের ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলামের আগমন ছিল যেন একটা ধূমকেতুর মতো। তিনি এসে বাংলা সাহিত্যকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছেন। তাঁর কবিতায় রয়েছে বিদ্রোহের সুর, যা আগে খুব কম দেখা গিয়েছে। বিশেষ করে “বিদ্রোহী” কবিতা তাঁকে বাংলা কাব্যের জগতে স্থায়ী স্থান দিয়েছে। এই কবিতায় তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন যে, তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন। নজরুলের কবিতা শুধু বিদ্রোহের নয়, তাতে রয়েছে প্রেমের কথাও। তিনি বলেছেন, “মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তুর্য”। অর্থাৎ, এক হাতে প্রেমের বাঁশি, অন্য হাতে যুদ্ধের ডঙ্কা। এই দুয়ের মিশ্রণ তাঁর কবিতাকে অনন্য করে তুলেছে।
নজরুল বাংলা কাব্যে নতুন ছন্দ এবং ভাষা নিয়ে এসেছেন। তাঁর কবিতা সহজ, কিন্তু গভীর। তিনি সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষের কথা বলেছেন, যেমন কুলি, মজুর এবং সাম্যবাদী চিন্তা। তাঁর “সাম্যবাদী” কবিতায় রয়েছে সবাই সমান হওয়ার বার্তা। তিনি লিখেছেন যে, অন্যায় দেখে তিনি চুপ করে থাকতে পারেন না। “বন্ধু বড় বিষ জ্বালা এ বুকে দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়েছি, তাই যাহা আসে কই মুখে” – এই লাইনগুলো দেখিয়ে দেয় তাঁর মনের ক্ষোভ। নজরুলের কবিতা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি শুধু কবিতা লিখেছেন না, গানও রচনা করেছেন যা আজও মানুষ গায়। তাঁর গানে রয়েছে প্রেম, দেশভক্তি এবং বিপ্লবের সুর। বাংলা কাব্যে নজরুলের অবদান এতটাই বড় যে, তাঁকে ছাড়া বাংলা সাহিত্য অসম্পূর্ণ। তাঁর কাজগুলো যেমন “অগ্নিবীণা”, “বিষের বাঁশি” এবং “দোলন চাঁপা” আজও পড়া হয় এবং প্রশংসিত হয়। নজরুলের কবিতা পড়লে মনে হয় যেন তিনি আমাদের সময়ের কথা বলছেন, যদিও তিনি অনেক আগের মানুষ। এজন্যই বাংলা কাব্যে তাঁর স্থান অটল।
নজরুলের কবিতা শুধু বাংলায় নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর চিন্তা ছিল মানবতাবাদী। তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা বলেছেন, যা তখনকার সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাঁর কবিতায় রয়েছে সত্য এবং সুন্দরের পূজা। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, এবং তাঁর লেখা রক্তের মতো গরম। “রক্ত ঝরাতে পারি নাতো একা তাই লিখে যাই রক্ত লেখা” – এই কথাগুলো দেখিয়ে দেয় তাঁর সংগ্রামী মনোভাব। বাংলা কাব্যে নজরুলের মতো কবি খুব কম আসেন, যারা সমাজ পরিবর্তনের কথা বলেন। তাঁর অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত।
কেন কাজী নজরুল ইসলাম আমার প্রিয় কবি
আমার জীবনে অনেক কবির কবিতা পড়েছি, কিন্তু নজরুলের কবিতা আমাকে সবচেয়ে বেশি ছুয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুলে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী পালিত হয়েছিল। সেখানে একজন আবৃত্তিকার “বিদ্রোহী” কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। সেই আবৃত্তি শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তখন সব কথা বুঝিনি, কিন্তু যা বুঝেছি তা আমার মনের কথা মনে হয়েছে। কবিতার প্রতিটি লাইন আমাকে যেন নিজের সাথে মিলিয়ে দিয়েছে। তারপর গ্রীষ্মের ছুটিতে মামার বাড়ি গিয়ে দেখি, ছোটমামার কাছে “নজরুল রচনাবলী” আছে। ছোটমামাও নজরুলকে খুব পছন্দ করেন। তিনি আমাকে নজরুলের জীবনের অনেক গল্প শোনালেন এবং কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। যেমন “খুকু ও কাঠবিড়ালী”, “লিচু চোর”, “খোকার সাধ”, “কুলি ও মজুর” এবং “সাম্যবাদী”। এই কবিতাগুলো পড়ে আমার মন নজরুলের প্রতি আরও আকৃষ্ট হয়েছে।
আরও বড় হয়ে নজরুলের আরও কবিতা পড়েছি। তাঁর “সংকল্প” কবিতায় লিখেছেন, “থাকব না ক বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগৎটাকে, কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে”। এই লাইনগুলো আমার কিশোর মনের কথা বলে মনে হয়েছে। আমারও ইচ্ছে হয়েছে এই সীমিত জীবন থেকে বেরিয়ে বিশ্ব দেখতে। নজরুল সমাজের পুরনো ধারণাগুলো ভেঙে নতুন সমাজ গড়ার কথা বলেছেন। তিনি আমার কাছে যেন একটা মহান পুরুষ, যিনি সৃষ্টির সুখে কাঁপেন। নজরুলের কবিতা আমাকে শিখিয়েছে যে, জীবনে লড়াই করতে হয় এবং প্রেম করতে হয়। তাঁর কবিতায় রয়েছে জীবনের সব রং – আনন্দ, দুঃখ, বিদ্রোহ এবং আশা। এজন্যই তিনি আমার প্রিয় কবি। তাঁর কথা শুনে আমি সবসময় অনুপ্রাণিত হই। নজরুলের মতো কবি যদি না থাকতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্য এত সমৃদ্ধ হতো না। তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা অসীম।
নজরুলের কবিতা আমাকে শিখিয়েছে যে, অন্যায় দেখে চুপ করে থাকা যায় না। তিনি নিজের জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছেন, কিন্তু কখনো পিছু হটেননি। তাঁর কবিতা পড়ে আমি বুঝেছি যে, জীবন একটা সংগ্রাম, এবং সেই সংগ্রামে জয়ী হতে হলে বিদ্রোহী হতে হয়। নজরুলের গান শুনলে মন ভরে যায়। তাঁর “কারার ওই লৌহকপাট” গানটি আমার খুব প্রিয়। এতে রয়েছে মুক্তির আহ্বান। এসব কারণে নজরুল আমার প্রিয় কবি, এবং আমি তাঁকে সবসময় মনে রাখি।
নজরুলের জীবনলেখ্য
কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ছিল খুব বৈচিত্র্যময় এবং সংগ্রামী। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ছিল ফকির আহমদ এবং মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। ছোটবেলা থেকেই নজরুল খুব দুরন্ত এবং খেয়ালি ছিলেন। গ্রামের মক্তবে তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়। কিন্তু লেখাপড়া ছেড়ে তিনি গ্রামের লেটো দলে যোগ দেন। পরে আসানসোলে একটা রুটির দোকানে কাজ করেন, মাসে পাঁচ টাকা বেতনে। সেখানে পুলিশের দারোগা রফিজউদ্দিন তাঁর প্রতিভা দেখে ময়মনসিংহে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করান। কিন্তু তিন বছর পর নজরুল সেখান থেকে পালিয়ে যান।
দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। নজরুল পড়াশোনা ছেড়ে বাঙালি পল্টনে যোগ দেন এবং সৈনিক হন। তাঁর কর্মদক্ষতায় তিনি হাবিলদার পদে উন্নীত হন। সৈনিক থাকাকালীন করাচি থেকে কলকাতার পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষে কলকাতায় ফিরে পত্রিকা সম্পাদনা এবং সাংবাদিকতা শুরু করেন। তখন প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত “বিদ্রোহী” কবিতা, যা তাঁকে রাতারাতি বিখ্যাত করে। এরপর তাঁর অনেক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যেমন “অগ্নিবীণা”, “বিষের বাঁশি”, “সাম্যবাদী”, “দোলন চাঁপা”, “সিন্ধু হিন্দোল”, “সর্বহারা”। তিনি শিশুদের জন্যও লিখেছেন, যেমন “ঝিলিমিলি”, “আলেয়া”, “পুতুলের বিয়ে”।
নজরুল ঔপনিবেশিক আমলে বেঁচে ছিলেন, তাই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লিখেছেন। তাঁর কবিতা বাজেয়াপ্ত হয়েছে এবং তিনি জেলে গেছেন। কিন্তু তিনি কখনো পিছু হটেননি। তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা বলেছেন এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। “প্রার্থনা কর যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ” – এই লাইনগুলো তাঁর সংগ্রামী চেতনা দেখায়। ১৯৪২ সালে তিনি একটা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন এবং ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মারা যান। তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। নজরুল সাম্যের কবি, সুন্দরের কবি। তিনি নিপীড়িত মানুষের কথা বলেছেন এবং পরাধীন জাতির মুক্তির কথা বলেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কবিতা প্রেরণা দিয়েছে। এজন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছে। নজরুলের জীবন আমাদের শিখিয়েছে যে, সংগ্রাম করে জীবন জয় করতে হয়।
নজরুলের জীবনের আরও কিছু ঘটনা বলি। ছোটবেলায় তিনি খুব দরিদ্র পরিবারে বড় হয়েছেন। বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁকে পরিবার চালাতে হয়েছে। তিনি লেটো দলে গান গেয়ে টাকা উপার্জন করতেন। সৈনিক জীবনে তিনি অনেক দেশ ঘুরেছেন, যা তাঁর চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে। কলকাতায় এসে তিনি পত্রিকা চালান, যেমন “লাঙ্গল” এবং “ধূমকেতু”। এই পত্রিকায় তিনি বিপ্লবী লেখা লিখে ব্রিটিশদের রোষানলে পড়েন। ১৯২২ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং জেলে যান। জেলে থেকে তিনি অনশন করেন এবং আরও লেখেন। নজরুলের ব্যক্তিগত জীবনেও অনেক উত্থান-পতন ছিল। তিনি প্রমিলা দেবীকে বিয়ে করেন এবং চার ছেলে হয়। কিন্তু রোগের কারণে তাঁর শেষ জীবন কষ্টের মধ্যে কাটে। তবু তাঁর সৃষ্টি অমর। নজরুলের জীবন আমাদের অনুপ্রাণিত করে যে, কষ্টের মধ্যেও সৃষ্টি করা যায়।
উপসংহার
প্রিয় পাঠক, এই লেখায় আমি চেষ্টা করেছি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন, কবিতা এবং কেন তিনি আমার প্রিয় কবি সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে। নজরুলের সৃষ্টি আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর বিদ্রোহী চেতনা এবং প্রেমের গান আজও প্রাসঙ্গিক। আশা করি, এই লেখা পড়ে আপনারা উপকৃত হয়েছেন এবং নজরুলের কবিতা পড়ার আগ্রহ জাগবে। এরকম আরও লেখা পড়তে আমাদের সাথে থাকুন। ধন্যবাদ।

 
			
 
    







